আলীর সুড়ঙ্গের পরাবাস্তব আখ্যান

মমতাজ উদ্দিন আহমদ:

আলীকদমের শান্ত প্রকৃতির মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আলীর পাহাড় যেন এক রহস্যের আঁধার। এর গভীরে লুকিয়ে থাকা সুড়ঙ্গগুলো কালের সাক্ষী, ধারণ করে অসংখ্য অশরীরী কল্পকথা। লোকমুখে ফেরা সেইসব কিংবদন্তীর আবছা আলোয় আজ আমরা প্রবেশ করব এক পরাবাস্তব জগতে, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমা অস্পষ্ট।
আলীর পাহাড়ের নামকরণের ইতিহাস ধূসর, তবে এর গায়ে লেগে থাকা রহস্যের ছোঁয়া আজও অনুভব করা যায়। জনশ্রুতি বলে, এই পাহাড় ও তার সুড়ঙ্গ এক ভিন্ন জগতের প্রবেশদ্বার। হয়তো সেই অজানার টানেই বহু বছর আগে একদল কাঠুরিয়া ভাগ্য অন্বেষণে এখানে এসেছিল।
একদিন, কাঠ কাটার সময় তাদের দলের একজন গভীর অরণ্যের নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যায়। সঙ্গীরা যখন তাকে খুঁজে ক্লান্ত, তখন সে এক অলৌকিক মায়াজালে বাঁধা পড়ে। গাছের পাতায় আচ্ছাদিত এক অপার্থিব রূপসী তাকে আলিঙ্গন করে, যার স্পর্শে পৃথিবীর সমস্ত সত্য যেন তুচ্ছ মনে হয়।
হারানো সেই কাঠুরিয়া আর ফেরে না। সঙ্গীরা ধরে নেয় কোনো বন্য জন্তুর শিকার হয়েছে সে। কিন্তু সত্য ছিল অন্য কিছু। সেই রূপসী, কোনো দূর নক্ষত্রের আলোয় গড়া মূর্তির মতো, তাকে টেনে নিয়ে যায় আলীর পাহাড়ের গভীরে, এক সুড়ঙ্গের আঁধারে।
সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে সময় থমকে দাঁড়ায়। দিনের আলো প্রবেশ করে না, রাতের তারারাও যেন পথ ভুলে যায়। সেই রূপসীর বাহুডোরে বন্দি কাঠুরিয়া এক নতুন জগতে প্রবেশ করে—যেখানে বাস্তবতা স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট। ধীরে ধীরে সে জানতে পারে, সেই নারী কোনো সাধারণ মানুষ নয়, বরং এই পাহাড়ের রহস্যময় আত্মার অংশ।
মাঝে মাঝে সেই রূপসী তার আসল রূপে আবির্ভূত হয়—এক বিশাল, শ্বেতকায় সত্তা, যার পরনে পশুর চামড়া আর অলংকার পাখির পালক। তারা আগুনের উত্তাপ চেনে না, বেঁচে থাকে প্রকৃতির দান ফলমূল আর শিকার করা পশু-পাখির মাংসের ওপর। কাঠুরিয়াও ধীরে ধীরে সেই অচেনা জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।
রাতের নিস্তব্ধতা তার মনে ভয়ের সঞ্চার করে। সেই অশরীরী নারীর পাশে নিজের অস্তিত্বকে ক্ষণস্থায়ী আর মিথ্যা মনে হয়। তার আলিঙ্গন ক্রমশ অসহ্য হয়ে ওঠে, যেন কোনো অদৃশ্য শেকল তাকে বেঁধে রাখে।
একদিন, যখন রহস্যময়ী নারী শিকারে যায়, সুড়ঙ্গের মুখ খোলা থাকে। কাঠুরিয়া দেখে, বাইরের পৃথিবীর আলো তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে পালিয়ে আসে, ফেলে আসে সেই পরাবাস্তব জগৎ। কিন্তু সেই মায়াবী স্পর্শ, সেই অচেনা ভয়—সবকিছু তার স্মৃতিতে জীবন্ত থাকে।
তবে সেই অশরীরী মায়ার বাঁধন কি এত সহজে ছিন্ন হওয়ার? লোককথা বলে, আজও আলীর পাহাড়ের গভীরে সেই রূপসীর দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, তার হারানো সঙ্গীর জন্য এক অসীম হাহাকার। আর গভীর রাতে, সুড়ঙ্গের মুখে নাকি দেখা যায় এক ছায়ামূর্তি—যার চোখে তার হারানো ভালোবাসার জন্য অনন্ত বেদনা।
এই কাহিনী কোনো বাস্তব ঘটনা নয়, হয়তো বা আলীর পাহাড়ের নীরবতা আর সুড়ঙ্গের অন্ধকার জন্ম দিয়েছে এমন রহস্যময় কল্পনার। তবে আজও যারা সেই পথে হাঁটেন, তারা হয়তো অনুভব করেন এক অশরীরী উপস্থিতির নীরব স্পন্দন—এক পরাবাস্তব জগতের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি।
লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ,
সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব,
বান্দরবান পার্বত্য জেলা।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 comments: