WHO এর সংজ্ঞা অনুসারে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সের এই সময়টাকে কিশোর বলে। এই কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত প্রত্যেকটি অন্যায় কাজকে কিশোর অপরাধ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। কিশোর দ্বারা গঠিত দলকে (Gang) কিশোর গ্যাং বলে।
বর্তমানে কিশোর গ্যাং বললে মানুষ আৎকে ওঠে।
২০১২ সালে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং নামের সন্ত্রাসী সংস্কৃতির প্রথম অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কিশোর গ্যাংদের পৃষ্ঠপোষকতা করে কথিত সন্ত্রাসী বড় ভাইদের হাত ধরে। কক্সবাজার সিটি কলেজের সামনে রিদুয়ান হত্যা,বরগুনার নয়নবন্ডের দ্বারা রিফাত খুন,বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড আর সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রনেতাদের দ্বারা স্বামীকে বন্দী রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ ইত্যাদি সব অপরাধই কিশোর গ্যাংয়ের বিষফল।
কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে পাড়ায় পাড়ায় মারামারি, কাটাকাটি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ এবং খুন খারাবি অহরহ ঘটছে। এদের আতঙ্কে অভিভাবকমহল উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে উৎকন্ঠিত।
কিশোর গ্যাং তরুণদের মাঝে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। টিকটক,লাইকিসহ নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পথভ্রষ্ট হয়ে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। উঠতি বয়সের পড়ুয়ারা স্কুল- কলেজ ছেড়ে একটি অংশ কিশোর গ্যাংয়ে ঝুঁকে পড়েছে। সুতরাং কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বেড়ে ওঠায় দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য এক মারাত্নক হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে।
শহুরে পাড়া মহল্লার অলিতে-গলিতে কিশোর - তরুণ প্রথমে ছোট ছোট গ্রুপ বা ক্লাব করে। তারপর "স্টার ক্লাব, "সাইজ কইরা দেয়, " আমিই বস"," আধুনিক পোলাপান", ইত্যাদি উদ্ভট নামে ফেইসবুকের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ করে। পর্যায়ক্রমে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। এ বয়সের পোলাপান বেশি আবেগী হয়। ভালোমন্দ বিবেচনা না করে কিশোর অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায়। তখন তারা তাদের চোখে উচু -নিচু দেখেনা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কোন গুষ্টি,দল কিংবা অন্য কোন এলাকার কিশোরদের উপর প্রভাবশালী হয়ে ওঠার স্বাদ পায় কাউকে মারধর বা লাঞ্ছিত করার মাধ্যমে।
ভিকটিমরাও তখন প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে যায়। তারপর তারা করে যায় একেরপর এক ঘটনা। প্রতিশোধ নেয় পাল্টাপাল্টি। ফলে ঘটে খুনাখুনি। এতে জড়িয়ে যায় স্থানীয় নেতারাও। তারা "বড় ভাই " হিসেবে আগলে রাখে গ্যাংগুলোকে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যাক্তিস্বার্থ রক্ষায় কিছু ক্ষমতাসীন নেতাও আছে যারা টাকা আর শেল্টার দিয়ে তাদেরকে অপরাধ সংগঠিত করায়। এর ফলে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় যেন নিত্যদিনের। এদেরকে কঠোরভাবে দমন করার নৈতিক দায়িত্ব প্রশাসনের। তাদের বিরুদ্ধে জরুরি অভিযান পরিচালনা এখনই সময়।
একসময় সমাজের ঐতিহ্য ছিল মুরব্বিদেরকে সম্মান করা, দূর থেকে দেখলে সালাম দিত,হাতে সিগারেট থাকলে ফেলে দিত। অন্যায় করতে দেখলে বড়জন ছোটদের শাসন করত। ছোটরা কারো সাথে বেয়াদবি করলে বিচার সালিশে বসাত। এখন সেই ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর নাই, চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। বাবা- মা'র সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি দেখার সময় তাদের নেই। টাকা আর রুজিরোজগার নিয়ে সদা ব্যস্ত। স্কুল-কলেজে ভর্তি করে দিতে পারলেই কি তাদের দায়িত্ব শেষ!? না দায়িত্ব আছে। দায়দায়িত্ব আছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের। কেউ এর দায়মুক্তি দিতে পারবেনা।
তাদের অপরাধের দায় সবাইকে নিতে হবে।
রাসুল (সঃ) বলেছেন-" অন্যায় ও পাপকাজ দেখলে কেউ যদি বাঁধা না দেয়, নির্মূল করার চেষ্টা না করে, অচিরেই তারা আল্লাহর আজাবে পতিত হবে"।
(তিরমিজি)
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম ব্যাপক শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলামি বিধান অনুযায়ী প্রথমত পিতা-মাতাকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। সন্তান কি করছে, সে কোথায় যায়, কার সাথে চলাফেরা, মোবাইল ফোন আর মাদক আসক্ত কিনা,অন্যায় কাজে লিপ্ত আছে কিনা, এসব বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরি। অপরাধের কারণে শাসন দরকার। আবার অতিরিক্ত শাসনও নিষ্প্রয়োজন। বিপদগ্রস্ত সন্তানকে রক্ষা করা মা-বাবার দায়িত্ব। আরো দায়িত্ব আছে সমাজ এবং সরকারের।
আল্লাহ বলেন- "হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেকে বাঁচাও এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকেও বাঁচাও"।
রাসুল (সঃ) বলেছেন - "তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ কর এবং তাদেরকে ভালো ব্যবহার শিখাও"।
সন্তানদেরকে সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক। নামাজের প্রতি উৎসাহ দিতে হবে। অসৎসঙ্গ পরিহার করতে হবে। অপসংস্কৃতির প্রতি নিরুৎসাহিত করতে হবে। খেলাধুলার প্রতি বিরত রাখা যাবেনা। ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে। কিশোররা বোঝা নয়, দেশের ভবিষ্যত।
লেখক- রবিউল আলম
সাবেক ছাত্রনেতা
0 comments: